আল্লাহ পাকের দিদার, আল্লাহর ইবাদতের অর্থ, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় - আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী
আল্লাহ পাকের দিদার:
আল্লাহর ইবাদতের অর্থ:
আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়:
সূরা আরাফের ১৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَمَّا جَاءَ مُوسَى لِمِيقَاتِنَا
وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ قَالَ رَبِّ أَرِنِي أَنْظُرْ إِلَيْكَ قَالَ لَنْ
تَرَانِي وَلَكِنِ انْظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ
فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا
وَخَرَّ مُوسَى صَعِقًا فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ
إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ (143)
"মূসা যখন আমার নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত
হলো এবং তাঁর প্রতিপালক তাঁর সাথে কথা বললেন, তখন মূসা বললো, হে আমার
প্রতিপালক! আমার কাছে দেখা দিন যাতে আমি আপনাকে দেখতে পারি । আল্লাহ বললেন,
আমাকে কখনও দেখতে পারবে না । বরং পাহাড়ের দিকে তাকাও, যদি তা নিজ স্থানে
স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখবে । যখন তাঁর প্রতিপালক পাহাড়ে তাঁর জ্যোতি
প্রকাশ করলেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেললো, আর মূসা জ্ঞানহীন
হয়ে পড়লো । যখন জ্ঞান ফিরে পেলো, তখন মূসা বলল, মহা পবিত্র আপনি, বা আপনি
দর্শন থেকে পবিত্র, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি এবং আমিই সর্বপ্রথম আপনার
প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি।" (৭:১৪৩)
আগের আয়াতের আলোচনায় আমরা জেনেছি, মহান
আল্লাহ তাওরাত গ্রন্থ গ্রহণ করতে হযরত মূসা (আ.)কে তুর পাহাড়ে চল্লিশ দিন
ধরে অবস্থানের আহবান জানান। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, হযরত মূসা (আ.) তুর পাহাড়ে
আসেন এবং মহান আল্লাহর সাথে কথা বলেন। হযরত মূসা (আ.)’র কাছে উত্থাপিত বনী
ইসরাইলের বিভিন্ন দাবির মধ্যে একটি দাবি ছিল, মহান আল্লাহকে চোখ দিয়ে দেখা ।
তাই, মূসা (আ.) মহান আল্লাহর কাছে এ দাবি পেশ করে বলেনঃ হে আল্লাহ যদি
সম্ভব হয়, তাহলে আমার সামনে এমনভাবে দেখা দিন, যাতে আমি আপনাকে আমার চোখ
দিয়ে দেখতে পারি এবং যাতে আমার জাতির কাছে এটা বলতে পারি যে, আমি আল্লাহকে
দেখেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ এর উত্তরে বলেনঃ না, তুমিও আমাকে কখনও দেখতে
পারবে না, কারণ, আমি দর্শনাতীত, অবশ্য আমার ক্ষমতা ও শক্তির নিদর্শন দেখতে
পাবে। আর এ জন্যে এ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখ, তা আমার ইচ্ছায় কিভাবে ধ্বংস
হয়ে গেছে। এ অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে হযরত মূসা (আ.) জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং
মাটিতে পড়ে যান। পরে হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলেন, আমি সবার আগে আপনার প্রতি
ঈমান আনলাম এবং আপনার শক্তি ও মহামহিমা বা মহা প্রতাপের সাক্ষ্য দিচ্ছি। আর
এ ধরনের অযৌক্তিক দাবি উত্থাপনের জন্যে আাপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। নিশ্চয়ই
আপনি চোখে দেখার অনেক উর্ধ্বে ও এ ধরনের সীমাবদ্ধতা থেকে পবিত্র ।
আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র কাছে এক
ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, আপনি কি আল্লাহকে দেখেছেন যে এভাবে তাঁর ইবাদত করছেন?
উত্তরে তিনি বললেন, যে আল্লাহকে আমি দেখি না বা জানি না আমি তাঁর ইবাদতও
করি না, অবশ্য দেখা বলতে আমি চোখ দিয়ে দেখা নয়, বরং অন্তর দিয়ে দেখাকে
বোঝাচ্ছি । অন্য এক সময় তিনি বলেছেন, আমি এমন কোনো কিছু দেখিনি যার সাথে
এবং আগে ও পরে আল্লাহ ছিলেন না । সূরা আনআমের ১০৩ নম্বর আয়াতেও মহান
আল্লাহ বলেছেন, চোখ তাঁকে দেখতে পারে না, কিন্তু তিনি সব চোখ দেখতে পান ।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. মহান আল্লাহকে জানা বা বোঝার জন্যে
তাঁর মহিমা ও ক্ষমতার নিদর্শনের দিকে লক্ষ্য করা উচিত এবং সমস্ত সৃষ্টি
জগতই আল্লাহর নিদর্শন ।
দুই. আল্লাহর কাছ থেকে অযৌক্তিক কিছু আশা করা ঠিক নয়, এ ধরনের আশা এবং আল্লাহ সম্পর্কে সব ধরনের ভুল ধারণার ব্যাপারে তওবা করা উচিত ।
সূরা আ'রাফের ১৪৪ ও ১৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ يَا مُوسَى إِنِّي اصْطَفَيْتُكَ
عَلَى النَّاسِ بِرِسَالَاتِي وَبِكَلَامِي فَخُذْ مَا آَتَيْتُكَ وَكُنْ
مِنَ الشَّاكِرِينَ (144) وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الْأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ
شَيْءٍ مَوْعِظَةً وَتَفْصِيلًا لِكُلِّ شَيْءٍ فَخُذْهَا بِقُوَّةٍ
وَأْمُرْ قَوْمَكَ يَأْخُذُوا بِأَحْسَنِهَا سَأُرِيكُمْ دَارَ
الْفَاسِقِينَ (145)
"আল্লাহ বললেন, হে মূসা! নিশ্চয়ই আমি
তোমাকে আমার বাণী ও বাক্যালাপের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।
তাই, আমি যা দিয়েছি তা অর্থাৎ তাওরাত কিতাব গ্রহণ কর ও কৃতজ্ঞ হও।" (৭:১৪৪)
"তাওরাত গ্রন্থে আমি তোমার জন্যে সব
বিষয়ের উপদেশ ও সব বিষয়ে বিবৃতি লিখে দিয়েছি। অতএব, তুমি তা দৃঢ়ভাবে ধারণ
কর এবং তোমার জাতির লোকদেরকে তার কল্যাণকর বিষয়গুলোকে গ্রহণ করতে বল। আমি
শিগগিরই তোমাকে সত্য ত্যাগীদের বাসস্থান দেখাবো।" (৭:১৪৫)
তুর পাহাড়ে ৪০ দিন অবস্থানকালে হযরত মূসা
(আ.)’র কাছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত গ্রন্থ নাজেল হয়। পাথরের ফলকে এ
ঐশী প্রত্যাদেশ নাজেল হয়েছিল। আল্লাহ এ গ্রন্থের বিধানগুলো কঠোরভাবে আঁকড়ে
ধরতে এবং বনী ইসরাইলকে এর বিধানগুলো মেনে চলতে বলার জন্যে হযরত মূসা
(আ.)’র প্রতি আহবান জানান।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ
এক. ফেরাউনের মতো অত্যাচারী ও খোদাদ্রোহী
শাসকদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত ও খোদায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর
এ রাষ্ট্রে অবশ্যই খোদায়ী বিধি বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে ।
দুই. ঐশী কিতাব বা খোদায়ী গ্রন্থ লাভের
জন্যে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আর এ ধরনের মহা অনুগ্রহের জন্যে
কৃতজ্ঞতা হিসেবে আল্লাহর বিধানগুলো মানা উচিত, কিছু নৈতিক উপদেশ প্রচারই এ
জন্যে যথেষ্ট নয় ।
সূরা আরাফের ১৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
سَأَصْرِفُ عَنْ آَيَاتِيَ الَّذِينَ
يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَإِنْ يَرَوْا كُلَّ
آَيَةٍ لَا يُؤْمِنُوا بِهَا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الرُّشْدِ لَا
يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الْغَيِّ يَتَّخِذُوهُ
سَبِيلًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا
غَافِلِينَ (146)
"পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে গর্ব করে
বেড়ায়, আমি শিগগিরই তাদেরকে আমার নিদর্শন হতে বিমুখ করবো এবং যদি তারা আমার
সমস্ত নিদর্শন দেখে, তবুও তারা এতে বিশ্বাস করবে না, যদি তারা সুপথ দেখে
তবুও তারা ঐ পথ গ্রহণ করবে না এবং যদি ভুল পথ দেখে, তবে তারা সে পথই গ্রহণ
করবে ; এটা এ জন্যে যে তারা আমার নিদর্শনাবলীতে অবিশ্বাস করেছিল এবং ওতে
অমনোযোগী ছিল।" (৭:১৪৬)
আগের আয়াতে আল্লাহর বিধান দৃঢ়ভাবে মেনে
চলা ও তা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে - যারা
আল্লাহর বিধানের কাছে নতি স্বীকার করে না এবং অহংকার করে, তারা সত্য গ্রহণে
প্রস্তুত নয় । এমনকি তাঁরা মহান আল্লাহর ক্ষমতার অনেক নিদর্শন দেখা এবং
সত্যের পথকে বোঝার পরও সত্য গ্রহণ করে না। আসলে তারা উন্নতি ও পূর্ণতার
পথের সন্ধান করে না এবং তারা যেখানেই যাক না কেন সত্য থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ
এক. মহান আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করা ও আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মূল উৎস হলো অহংকার বা গর্ব ।
দুই. আল্লাহর মোকাবেলায় অহংকারের পরিণতি হলো সুপথ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং আল্লাহ বিনা কারণে কারো ওপর অনুগ্রহ করা বন্ধ করেন না। #
Source: http://bangla.irib.ir